বুধবার, ৩০ নভেম্বর, ২০১৬

                                                        তাহাদের অভিন্ন অগল্প
                                                                                    

                                                                            
                                                                                


-‘স্যার, আমি কপি করি নাই স্যার! বিশ্বাস করেন! সত্যি স্যার, আমি নিজে কোড করছি স্যার, সত্যি স্যার, আমি কপি…’

-‘অ্যাইই, কীসের কপি করছো? অ্যাইইইই! ওঠো আটটা বেজে গেছে, ওঠো অফিস যাবা না? অ্যাইই!‘
-‘দোস্ত নাবিলাকে বলিস আমার প্রক্সিটা দিয়ে দিতে, প্লিজ দোস্ত, প্লিইইইইজ…’
-‘অ্যাইইই!!!! ওঠো বলছিইইই! ভালো হবে না কিন্তু!’

রান্নাঘর থেকে এক মগ জল নিয়ে এসে ধুম করে শফিকের মুখের মধ্যে ঢেলে দেয় হৃদিতা।ধড়াম করে উঠে বসে শফিক।চোখ কচলাতে কচলাতে দেখে চোখ মুখ লাল করে রুদ্রমূর্তি ধারণ করেছে হৃদিতা।

-‘নাবিলা কেএএ???’
-‘কে? না-বি-লা? কোন নাবিলা? কোথাকার নাবিলা?’
-‘ঘুমের মধ্যে তারে মনে থাকে, আর আমার সামনে মনে পড়ে না, নাআআ??’
-‘কী বলেছি আমি ঘুমের মধ্যে?’
-‘কী সব বলছিলে, প্রক্সি, অফলাইন-কী সব জিনিসপ্ত্র।তোমার কি অফিসে কাজের চাপ বেশি পড়েছে?’
-‘ওহহহ! স্বপ্ন দেখছিলাম নিশ্চয়।ক’টা বাজে? আটটা!! কী বলো! ডাক দাও নি কেন?’
-‘ডাকিনি আবার! কুম্ভকর্ণের মতো ঘুমাচ্ছো আবার ডাকলে নাবিলাকে প্রক্সি দিতে বলছো! ইয়ার্কি করো আমার সাথে?’

বিছানা থেকে ধড়াম করে উঠে একদৌড়ে ছুট লাগায় শফিক।
‘আহারে! কী সব দিন ছিল! খালি প্রক্সি আর প্রক্সি।হে আমার প্রক্সি নাবিলা, তুমি এখন কোথায়????!’


                                                                          ২

টেবিলে দু’টো ল্যাপটপ।একমনে এক জুনিয়র সহকর্মীকে কিছু একটা বোঝাচ্ছে নাবিলা।বছর দুই হলো টেক্সাসে সে।নিরিবিলি একটা বাসায় থাকে সে আর তার ইউনিভার্সিটি শিক্ষক স্বামী।দেশের একটানা খাটুনি ভালো লাগেনি তার।তাই জামালের একটা ইউনিভার্সিটিতে চাকরি নিশ্চিত হতেই পরিচিত কানাডিয়ান প্রফেসরের রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে টেক্সাসে চলে এসেছে সে।

-‘হ্যালো মিস্টার রিচার্ড! গুড মর্নিং।হ্যাভ ইউ কম্পলিটেড দ্য টাস্ক আই অ্যাসাইনড ইউ লাস্ট উইক? নো?!!! বাট হোয়াইইইই!’

এক রিসার্চ কলিগকে ঝাড়ি দিতে দিতে ওর খুব চায়ের তৃষ্ণা পায়।পলাশীর মাল্টা চায়ের তৃষ্ণা।জানালার বাইরে চোখ যেতেই ও দেখতে পায়…

নাহ! কিছুই দেখতে পায় না।চোখ ঝাপসা হয়ে আসে একটু।গত দু’বছরে কিছুতেই টেক্সাসে মানিয়ে নিতে পারছে না সে।আশেপাশে অনেক বুয়েটিয়ান।কিন্তু তবুও কী যেন একটা মিস করে সে।ভাবতে ভাবতে ফেসবুকে লগ ইন করে সে।পুরাতন সেই গ্রুপে ঢুকতেই চোখে পড়ে র‌্যাগ প্রোগ্রামের হাসি-কান্না মাখা মুখ।হাজারো স্মৃতি বিজড়িত সেই কাভার ফটো।নোটিফিকেশন চেক করতে করতে হঠাৎ-

-‘ইয়াহুউউউ!!!!’
হঠাৎ করে চিৎকার দিয়েই লাফিয়ে ওঠে সে।সবাইকে নিজের দিকে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে থাকতে দেখে সম্বিত ফেরে তার।


                                                                       


‘ধর ব্যাটারে ধর! ঐ পালাচ্ছে কেন!!! সালাম সাহেব,আপনি উলটো দিক দিয়ে যান।দৌড়ান,ঠিক ঐ দিকের মোড়টায় একশন নিয়ে রেডি থাকবেন। মিরাজ সাহেব , আপনি ঐ দিকে যান, আমি এখানে আছি।‘
পুলিশের পোশাকে বেশ মানায় দীপ্তকে।অবশ্য ‘সাদা পোশাকের পুলিশ’ হতেই ওর বেশি আনন্দ।চার বছরের ইঞ্জিনিয়ারিং সাড়ে চার বছরে শেষ করে সবাই যখন জিআরই আর টোফেল দিচ্ছে, তখন ও বিসিএস দেয়ার ডিসিশান নেয়।ইচ্ছা ছিল দেশেই থাকার।মা-বাবার সাথে।রেজাল্ট যে খুব একটা ভালো ছিল এমন নয়-কিন্তু, টেনেটুনে ইউএস এর মিডিয়াম কোয়ালিটির কোনো ভার্সিটিতে হয়ে যেতো ওর।আশেপাশের সবাই বললো চলে যেতে, কিন্তু মা বড় খুশি হয়েছিলেন।প্রথম বারেই বিসিএস এ হয়ে গেল।পুলিশে যোগ দিতেই ওর কাজ করার ধরণ, ব্যাকগ্রাউন্ড দেখে ডিটেকটিভ ব্র্যাঞ্চে ট্রান্সফার করে দেয়া হলো তাকে।সেই থেকেই চলছে দৌড়-ঝাঁপ।মাঝে মাঝে পলাশীর ঐ দিকে যাওয়া হয়, পরিচিত মুখ খুব একটা চোখে পড়ে না।ভালো লাগে না আর দেশে থাকতে।বন্ধুদের সাথে সেই অফলাইন আর অনলাইনের দিনগুলোকেই এখন মিস করে সে।

                                                                       
                                                                     


-‘কাল আমাদের একটা নতুন প্রোডাক্ট লঞ্চ হচ্ছে বুঝলি? সেই লেভেলের জিনিস।আমার টিমে অবশ্য শুধু একটা মডিউল নিয়েই কাজ করা হয়েছে, সেটার রেসপন্স টাইম আর এরর লেভেল কমাতেই গত ৩ সপ্তাহ কেটে গেলো।তুই ও বুঝবি, শোন জিনিস টা হচ্ছে…………’

আজাদ অস্ট্রেলিয়ায় থাকে।নামকরা এক টেক কোম্পানিতে মোটা বেতনের চাকরি তার।সবচেয়ে বড় কথা-কাজটাকে সে বড় ভালোবাসে।প্রতি মুহূর্তে নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ, নতুন সুযোগ, এক্সাইটমেন্ট! মনেই হয় না যে এসিএম এর দিনগুলো ফেলে এসেছে দূর স্বদেশে।রাতের বেলার পেনাং আর পলাশী অবশ্য মাঝে মাঝেই মনে পড়ে।হ্যামবার্গার আর ডায়েট কোকে কি পলাশীর চাইনিজের স্বাদ মেলে নাকি? তাই মাঝে মাঝেই স্কাইপে আড্ডা দেয় শফিকের সাথে।শফিক তার রুমমেট ছিল।জীবনের সোনালি সময়ের একটা বড় অংশ শফিকের সাথে আড্ডা মেরেই পার করে দিয়েছে সে।স্কাইপেও তাই কথার অভাব হয় না।


আড্ডা শেষে ফেসবুকে ফিরেই দেখে রিশাতের ম্যাসেজ।ডিপার্টমেন্টে ডে হচ্ছে দু’বছর পরে।ওদের ব্যাচের সবাই এবার একটা গেট-টুগেদারের জন্যে মাতামাতি শুরু করেছে।

ম্যাসেজ দেখেই সাথে সাথে কল দেয় সে দীপ্তকে।বেচারা সিংগেল আছে এখনো।ওর সাথে থাকার কথা বলে নেয়।প্রজেক্টের চিন্তা শিকেয় তুলে ঘুম দেয় আজাদ।স্বপ্নে ভেসে আসে তার রঙ্গিন দিনের ঘুড়ি।


                                                                       


-‘এবার আসছে আমাদের দীর্ঘ প্রতীক্ষিত ইন্সট্রুমেন্টাল!’

নাবিলার কথায় তুমুল করতালি পড়ে অডিটোরিয়ামে।দো’তালার বিশিষ্ট শুভাকাংক্ষীদের পক্ষ থেকেও চিৎকার ভেসে আসছে।থিম সং গাইতে গাইতে জুনিয়র ছেলেমেয়েরা নেচে বেড়াচ্ছে গোটা অডিটোরিয়াম জুড়ে।শফিক স্টেজের চারপাশে পাগলের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে।কেউ কেউ নাস্তা দিয়ে বেড়াচ্ছে ঘুরে ঘুরে।বেলুন, ব্যানারে খুব সুন্দর লাগছে চারপাশটা।আজাদ স্টেজের দিকে তাকায়।ধীরে ধীরে পর্দা উঠছে।ব্যানারে বড় বড় করে লেখা- ‘iPay CSE DAY 2016’

সোমবার, ১৮ জানুয়ারী, ২০১৬




সময়ের ছায়াপথে



আশেপাশে তাকাই, দেখি অদ্ভুত ছায়াঘেরা সময়
নীরবে মুছে ফেলে দিই বাউন্ডুলের যতো ভুল কবিতা
হৃদয় আর হৃদয়হীনতার যুদ্ধে জয় হয় সভ্যতার

সত্যজিত কিংবা হেমিংওয়ে, খুব একটা টানে না আর
ব্যস্ত দিনলিপির শেষে হাইপোথিসিস জমতে থাকে
ঘুমের দরজায় দাঁড়িয়ে থাকে আগামীকালের স্বপ্ন
এলোমেলো অনুভূতির আনাগোনা জীবনের চৌকাঠে
কাকের ডাক আর বারেবারে বিরক্ত করা এলার্মের শব্দ
কিছুতেই আমাকে বিছানা থেকে ওঠাতে পারে না

আজব এক নেশা আমার দু’চোখের পাতায়


যেন দীর্ঘদিন অনিদ্রায় কাতর শরীর আর মন

আজ আমি ঘুমোতে চাই।



মঙ্গলবার, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

হয়তো বা কাল্পনিক


তুই কিন্তু আজও আসলি নাহ!

কানের কাছে অচেনা একটা হলুদ পাখি এসে ডেকে গেল অবিরাম

    ‘ওঠ! সকাল হয়েছে।চল অনেকদিন মেঘের বাড়ি যাইনি।দেরি করিস নাহ। চল!’

আমি বললুম, ‘আগে সেই গভীর কালো চোখ দু’টোকে দেখি।তারপর না হয়


হলদে ডানার পরী বিরক্তির সুরে একটার পর একটা গান গাইতে লাগলো।যেন দূর হতে ভেসে আসছে সে সুর।কোনো এক কল্পলোকের জোছনা হতে দৌড়ে এসে জাপটে ধরলো আমায়।

কিন্তু কই?
      তুই তো আজও আসলি নাহ
……

কেটে গেল অনেক মিনিট,সেকেন্ড,ঘণ্টা

যেন এক একটা শীত,বর্ষা,হেমন্ত


ক্লান্ত টেবিলটায় মুখ গুঁজে চুপচাপ পড়ে থাকলাম আমি।যেন বা ভুলেই গেলাম-আজ তোর আসার কথা।

এক পা, দু’ পা করে এগিয়ে যাচ্ছি অসীমের পানে।উদ্দেশ্য কিন্তু একটাই।

বিজয়?
নাহ।তোকে খুঁজে পাওয়া।

দরজাটা খুলে দিলাম।আচমকা একরাশ আলো এসে ঝলসে দিলো চোখ দু’টো।


-‘তুই এসেছিস!’ যন্ত্রের মতো কণ্ঠ্য আমার আজ কেমন প্রাণময় হয়ে উঠলো যেন।

-‘পাগল কোথাকার! তোর মাঝেই তো আমার বসবাস।তোকে ছাড়া আমায় আর কোথায় খুঁজে পাবি বলতো?’- পরিচিত কণ্ঠ্যে মৃদু ধমকের ছোঁয়া।




সাঁঝ পেরিয়ে এখন অনেক রাত।
আকাশে থালার মতো চাঁদ।
একটা-দু’টো তারাও দেখা দিয়ে জানান দিচ্ছে-
  ‘আমাদের ভুলে যেও না যেন!’

সামনে একটা ক্যানভাস।স্বচ্ছ তুলির আঁচড় যেন ক্ষণিকেই বদলে দিচ্ছে সামনের জগত।

এখন বৃষ্টি হচ্ছে।আমরা দু’জন পাশাপাশি দৌড়াচ্ছি।ভিজে কাক হয়ে যাচ্ছি।আপত্তি নেই।একটু পরেই হয়তো সামনে দেখবো-ঝরণার প্রবাহধারা।ডাকছে।অবগাহন করবো সেখানেও।
তারপরে তুষারপাত,ডুবসাঁতার
……


অন্তত পরাবাস্তবতার জগতে আমরা চিরসঙ্গী।
একজোড়া হলুদ ডানার পাখি।

আকাশের ভাঁজে ভাঁজে।










শনিবার, ৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

জোছনা

          -আগন্তুক



‘কে?
কে ডাকে?
রাত-দুপুরে আমার দরজায় কে টোকা মারে?’
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে এলোমেলো চুলের ছেলেটা
আজকাল এভাবেই কথা বলে।
কেউ সাড়া দেয় না।
কল্পনায় অথবায় বাস্তবতায়।
জানালার ওপাশের সোনালি রোদ্দুর
আর নীল খামেদের জগত
দূর থেকেই বিদায় দেয় তাকে।
কাছে আসে না।
কী জানি!
কাছে আসলে যদি
বিষণ্নতার বাদলা হাওয়া
ভাসিয়ে নিয়ে যায় তাদের মুহূর্তগুলোকেও!

তাই গাংচিলের অবহেলায়
শালিকের ক্যানভাসটা রং হারাতে থাকে,
এক সময় রক্তের গাঢ়তা নষ্ট হয়ে যায়।
ফ্যাকাশে হয়ে যায় মেঘগুলো।
তবুও দু’চোখে সবুজ ছড়িয়ে
মেয়েটা দাঁড়িয়ে থাকে সাদা বাড়িটার ওপাশে।
এখানেই যে তাদের দেখা হবার কথা ছিল।
সেই জোছনাধারায় সিক্ত হয়ে ভালোবাসার কথা ছিল।
তাই খোঁপায় তাজা গোলাপের কষ্ট চেপে রেখে
অপেক্ষা করে যায় মেয়েটা।
কতো যুগ আগের সেই একটা কথার জন্য।
আঁধার ঘনিয়ে আসা গোধূলিতে
কেউ যে তাকে বলেছিল-
‘তুই দেখিস, আমি ঠিকই আসবো।
অপেক্ষা করিস; একটু দেরি হলে চলে যাস না যেন!’

তাই তো কাজল চোখের সবুজ
আজও অপেক্ষা করে যায়।
তার এক আকাশ নীলের জন্য।
শুধু তার নীলের জন্য।

চাঁদ আসে।
চাঁদ যায়।

শুধু সেই জোছনাটা আসে না।
হয়তো কোনোদিন আসবেও না।